এখনও মাদুর বা দৈবাৎ আলেখ্য!
ego sum qui sum – Exodus 3:14
দৈবাৎ উঠে আসে না। হেঁটে তো আসেই না; কিসের চেষ্টায় আসে তা জানা না জানা দুই–এর প্রয়োজনই এক অসভ্য আলেখ্য, অসত্যও বটে, যদিও ওমনিই আসে, ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আসে! এই হীন, এই আক্ষেপ অস্পষ্ট, এই গভীর উহ্য থাকতেই পারত সেই পাতলুনের বা সেই কাম্বিজ ব্যাগটির ক্লিষ্ট পকেটে পকেটে অবশিষ্ট তড়িৎ-আম্লিক মিশ্রের মত, দাঁতের বিছানায় চর্বিত কনিকার মত। বাকি রাখা সখি সখি ক্রীড়া সমূহ আর সেই ‘বুঝি এই নারীই, এইবার, এইবার আমারই’ কিংবা সেই অবশিষ্ট মলিন শাদা জামার পরতে পরতে মার খাওয়া ভীতি সারা দিনের পরও অকিঞ্চিৎকর মনে হত যা , কখনও কোন আধখসা ভাললাগার কষ্ট যে কষ্টই মাত্র, আর বাড়ি ফেরার পরেই সেই কৃচ্ছসাধনও অনুচ্চ ঝাপর মেরে ঈষৎ বলে দিত, ‘ওহে ক্ষীণবিত্ত মনোবৃত্তি, ওহে পুরুষক্রমে প্রাপ্ত প্রথার অর্ঘ্য, তুমি তুমিই, এই বালিকাটি তোমার নয়, সে একমাত্র রাজামশায়ের কারন, এই পাঠ্য বইগুলির বক্তব্য পাঠোদ্ধারই তোমার আহৃত কর্তব্য, কোনমতে ভাল থাকবার সটীক উপদেশ শ্রেয় এই বালিকাটি বা পরিস্রুত নারীটি বা এটা সেটার থেকে’। এমনিই। রাজামশায় জাদু মাদুরে শনি গ্রহে, মঙ্গল পেরিয়ে। রোমন্থন বৃত্তাকারে আসে, অযান্ত্রিক ভালো লাগার যন্ত্রণা আনে।
মাদুর আজও বসে আছে কিছু যন্ত্রণা নিয়ে, আজকালকার বহুল প্রচলিত ফেসবুক, ট্যুইটার, গুগুল প্লাস, ইন্সটাগ্রাম আর সব খোঁজযন্ত্রকে কি আর কেন খুঁজে খুঁজে কাতর ও কুঞ্চিত আমি, জানি কোনমতেই সেই এলাডিং ধরা দেবেনা, রোজ রোজ কত কত চেষ্টার পরও সে ধরা পড়ে না। অমোঘ এবং নিয়ম! যেমন এই পঁচিশ বৎসর কালের মতই, সুপ্রাচীন ঘটিত কৌমার্য নিঃসারণের মতই, রোজনামচার মতই সমস্ত আবেগ সঞ্চয় করে আবার দেখে নেয় বা না চাইলেও দেখে যায় এই ঐকান্তিক স্বক্রীড়ার বসনাই বহুকাল অতীত; নিবীর্য অন্ধকার আন্তর্জাল মেখে নেয়, ধীরে, ধীরে, এইটুকুই! 'তুমি তখনও সেই তুমি এখনও তুমিই রয়েছ! আকাশ তখন পরিস্কার; মলিন এখন! তবু আকাশই একমাত্র প্রত্যয়! সেইখানেও তুমিই, দাঁড়িয়ে এবং বসে।'
যা যা ভেবে নিলে নারী, ভুবনমোহিনী নারী উঠে আসে, প্রেম উঠে আসে, বলে দেয় এইই ভুবনের বাস্তবিক মোক্ষলাভ এবং তা যে নয়, তা জানতে জানতেই আমি বিদ্যালয় ত্যাগী, আমি ভূষণপ্রাপ্ত, পরে। তারপরে, যখন প্রেষ্যপ্রাপ্তি বড় ছাড়িয়ে বৃহৎ হল, বিবাহ করলাম, সন্তানাদি আনলাম, ধরিত্রী ধন্য হয়েছিল! বুঝলাম আমিই সেই আলেখ্য। আর তুমি ব্যাপৃত হলে বটে, নানা কর্মে নানা সঙ্কটে লাঙ্গুলহীন বীর অঞ্জনিপুত্র তোমার কী দাপট! কী তোমার তামাশা! এই দৃশ্য, এই শব্দ প্রকট তোমার মদিরায়, পাত্রে, গাত্রে তোমার সজ্জায়; শয্যায় তোমার বধুটির কিন্নরী ইতস্তত অস্থির অভ্যন্তর, ‘অসহ্য! একটু ঘুমোতে দেবে কি না!’ তুমি যা যা কিছু খুঁজেছ, পেয়েছ কিছু তবু বালিকাটি এখন সেইরূপ থাকবেনা কেন! নানা স্থান, বাহানা, তাল, কিছু অনবদ্য কাল; সব উঠে আসে, নানা মন্তাজ উঠে আসে মার্জার গতিতে, তোমার কুকুর বশ্য থাকে দড়িতে! অবশ্যই ডাক ছাড়ে থেকে থেকে! বাড়িতে।
লুপ্ত অভ্যাস, যেমন শঙ্খের, উলুর, যেমন কাসরের, গঙ্গাজলের, সেইরকম আনন্দ গত পঁচিশ বৎসরে সরে সরে গেছে, ঠিক কতটা দূরে জানবে না! ছোট ছোট বন্ধু হয়েছিল, ফল ধরেছিল, গাছে, তাদের ভবিষ্যৎ থেকে তুমি দেখতে নাম অতীতে, তাদের স্পর্শ কর দৃষ্টিতে দৃষ্টিতে, ঢেউ ইত্যাদি আজও সেই ডানপিটে নানা সৃষ্টিতে , সেই জল-বোতলে, সেই জুতোগুলোয় আজ আনন্দ লেগে নেই তবু বেশ লাগে! তুলে রাখা যায়, রাখার মত তবে তোমার দূরে যেখানে কেউ নেই অথবা আছে আকরে আকরে, আর খোলা হাওয়ায় সেই সহপাঠী যারা বেঁচে চেষ্টা করে ঘুমোতে এবং প্রায় প্রত্তেক না ঘুমনো রাতে এখনও শয্যা পাতে, তোমার মত! আমি জানি, অনেকটা বহমান নান্দনিক ধারায় ভাবে যদি ঘুম আসে বালিকা ফিরে যাবে তবে বাড়িতে বাড়িতে আলো জ্বলে; তা না জ্বলতেই পারে। ঘুম আরেকটি লুপ্ত অভ্যাস! ছোটবেলায় ছিল, হারিয়েছে অন্য কারনে, আমি বুঝিনি, তুমি বোঝনি! মাঝরাতে পেঁচা ইঁদুর পায়, শীত নামে ও জানে বৃত্তাকারে এরপর ঋতুরাজ! বাংলা আন্টির মুখ মনে পরে, চতুর্থ শ্রেণী! নাকি প্রথম হয়রানি!
এই সেই ছোটবেলা! ছোটবেলায় ভয় করলে গুহ্যদ্বারের তিন ইঞ্চি উপরে টান মারত আর ভীষণ ব্যাথা করত তখন, বন্ধুরা বলত- ‘দ্যাখ শুকিয়ে গ্যাছে’, বুঝতাম না ওরাও না বুঝেই বলত – বড়দের থেকে শেখা। ওরা দাঁত বের করে হাসত। আমিও হাসতাম যখন রাম, শ্যাম, যদু এবং ইন্দ্রজিতেরও শুকিয়ে যেত। আমি, ভয়, আর শুকিয়ে যাওয়ার সমানুপাতিক সম্পর্কের টানে সেই শিরশিরানি ক্যামন পা বেয়ে নেমে নেমে যেত। একসময় ভুলে যেতাম, জীবনও চলত গতানুগতিক। সে ফিরে আসত – সাইকেলে চেপে, প্রশ্নপত্রে মেপে, কখনো অসহিষ্ণু আমি, রাস্তার মাঝে আমি আর কুকুরের একসাথে পার হত কৈশোর কাল, শুকিয়েই যেত অবান্তর। ইতিহাসের রূপ ধরে, ভূগোল চুপ করে কোনও কোনও রেসাল্টের আগের রাতে। হাফ্প্যান্টে ঢাকা চতূর্মুখী গ্রন্থিতে বসে পড়ত আর কি টান – ঊফ্! মাগো! খালি জেনেছিলাম ওর আরেক নাম কায়াহীন। এই ভয় নিয়েই বড় হতাম, ছোট হতাম। আগুপিছু না ভেবে এগোতাম আর পিছতাম। সারাদিন সারারাত গুহ্যদ্বারের ইঞ্চি তিন উপরে মারত টান, বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতাম। রাম, শ্যাম, যদু এবং ইন্দ্রজিতের কাছে কোনোদিন শুনিনি ওরাও ভয় পেত তখন বালিশের কাছে সব বলত কিনা। আমি বলতাম- জড়িয়ে ধরে, থুতু লাগিয়ে ভিজাতাম সারা গা – তারপরই আমার ক্ষয়। সমস্ত শরীর তিন ইঞ্চি হয়ে আমার মিনার ছোট হতে হতে ভীষণ রূপ ধারণ করে - যতনের শরীর বেয়ে বীভৎস শীত উঠে পড়ে।
এ কার শরীর! পোকার মত ছোট – কুড়িটা আঙ্গুল থেকে কুড়িটা গাছ ক্ষেপণাস্ত্র হয়ে ছুটে যাচ্ছে, ধেয়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে উড়ে! পোকাটার কালো দেহের নিচে লুকিয়ে আমিই বসে আছি শাদা হয়ে। সেই গাছগুলো থেকে আরও ডালপালা, পাতা বেড়িয়ে তালে তালে নৃত্যরত, ফল ধরেছে কালো, কাঠবেড়ালি কালো, কাঠ কালো, বেড়াল কালো, আকাশটাও ক্যামন প্রতিযোগিতার জালে কালো হয়ে গ্যাছে – ক্ষেপণাস্ত্র ছুটতেই একটা ফল ফেটে পড়ল মাটিতে – দেখি আমার পাশের কুকুরটা, আমার সঙ্গী, আমার ধর্ম, আমার বর্ম, দৌড়ে ভূলোক থেকে সমস্ত গতি নিয়ে, আলোর থেকে বেশী দূরে পড়ে থাকা ফলটা খেতে যাচ্ছে। আবার ভয় পেলাম, চিৎকার করব যেই, দেখি আগুন লেগে গ্যাছে ততক্ষণে চারিধারে, চোখে, মুখে – কালো ধোঁয়া উঠছে গল্গলিয়ে।
কে সেই দ্বিখন্ডিত ফলের মাঝে জাঁকিয়ে বসেছে! একি মধুসুদন দাদা! কালো অদ্বৈত আনাদি শালগ্রাম শিলা বসেছে জমিয়ে। অখন্ড প্রজ্ঞায় মেতে উঠেছেন, স্বমন্তক মণির দুস্টুমি ভরা অনির্বচনীয় আদিভৌতিক অব্যয়ের হাসি হেসে। তারা মণ্ডল মুছে মুছে, নতুন নতুন গল্প লিখে সমস্ত দ্যুলোকের তারই জ্বালানো আর নিভে যাওয়া আলোয় ভেসে ভেসে। আর আমি বলতে চাইছি চিৎকার করে- আমায় মুক্ত কর, আমায় বদ্ধ কর, আমায় জমিয়ে দাও, আমায় পুড়িয়ে দাও আমায় প্লাবন কর, আমায় সৃষ্টি কর, আমায় ধ্বংস কর, আমায় ভয় দাও আরও, আরও, আরও, মারো আরও, আমার চোখ উপরে নাও, আমার অহংকার খুবলে দাও, আমায় ডুবিয়ে দাও, আরও শুকিয়ে দাও, আমায় শান্ত কর, আমায় নির্বিষ কর। আমার বিষদাঁত দাও, আমার জ্বরা দাও, আমায় যৌবন দাও, আমার বাস্তব কারো, আমায় স্বপ্নে ভর। ঠিক তখনই আমার পাশের কুকুরটা, আমার সঙ্গী, আমার ধর্ম, আমার বর্ম, দৌড়ে, ভূলোক থেকে সমস্ত গতি নিয়ে, আলোর থেকে বেশী দূরে পড়ে থাকা ফলটা খেতে খেতে চলে গেল, আমায় ভয়ঙ্কর একখানা বসন্ত দিয়ে!
মাঝরাতে পেঁচা ইঁদুর পায়, শীত নামে ও জানে বৃত্তাকারে এরপর ঋতুরাজ! বালিকাটির মুখ মনে পরে, আজ শেষ দশম শ্রেণী!
Comments
Post a Comment